বিশ্বব্যাপি নারীদের মৃত্যুর কারণের তালিকায় স্তন ক্যান্সারের অবস্থান দ্বিতীয়।
‘আমেরিকাল ক্যান্সার সোসাইটি’র তথ্য মতে, “প্রতি আটজন নারীর মধ্যে একজন তার জীবনকালে এই রোগে আক্রান্ত হন।”
‘বেভারলি হিলস’য়ে অবস্থিত ‘পিঙ্ক লোটাস ব্রেস্ট সেন্টার’য়ের ‘ব্রেস্ট ক্যান্সার সার্জন’ ডা. ক্রিস্টি ফাঙ্ক ‘রিয়েলসিম্পল ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেন, “পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ স্তন ক্যান্সারের পেছনে বংশগত কারণ দায়ী থাকে। ১৩ শতাংশ রোগীর ‘ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেটিভ’ থাকেন যাদের এই রোগ ছিল।”
ক্রিস্টি ফাঙ্ক তার ‘ব্রেস্টস: দ্য ওনার’স ম্যানুয়াল’ বইতে লিখেছেন, “জিনগত ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের বাইরে হলেও, মনে রাখা জরুরি যে সিংহভাগ স্তন ক্যান্সার নারীর নিজের নিয়ন্ত্রণে। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কিছু অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে এই প্রাণঘাতি রোগকে দূরে রাখা সম্ভব।”
পরীক্ষা করা: ঋতুস্রাব শুরু হয়ে গেলেই প্রতিটি নারীর উচিত প্রতি মাসে নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করানো। দেখতে হবে স্তনে এমন কোনো দাগ কিংবা ‘লাম্প’ বা গোটা টের পাওয়া যায় কি-না যা আগে ছিল না।
কীভাবে পরীক্ষা করতে হবে তা জানতে অনলাইনে ‘টিউটোরিয়াল’ দেখতে পারেন কিংবা সরাসরি চিকিৎসকের কাছ থেকে শিখে নিতে হবে।
ম্যামোগ্রাম: নিজে পরীক্ষা তো করবেনই, বয়স যখন ৪০’য়ের কোঠায় পৌঁছাবে তখন নিয়মিত ‘ম্যামোগ্রাম’ করতে হবে।
‘বেভারলি হিলস’য়ের ‘বেডফোর্ড ব্রেস্ট সেন্টার’য়ের স্তন-স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. হেদার রিচার্ডসন বলেন, “৪০’য়ের পর থেকে ‘ম্যামোগ্রাম’ করানো সাধারণ নির্দেশনা। তবে চিকিৎসক এতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারেন। যেমন, পরিবারে যদি কারও স্তন ক্যান্সার থাকে তবে আরও আগে থেকেই ‘ম্যামোগ্রাম’ করানোর পরামর্শ দিতে পারেন চিকিৎসক। আপনার স্তনের ঘনত্ব জানা যাবে এই ‘ম্যামোগ্রাম’ থেকে। যার স্তনের ঘনত্ব বেশি তার জন্য বাড়তি কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।”
উদ্ভিজ্জ খাবার: ডা. ফাঙ্ক বলেন, “যখনই কিছু খাই তখনই আমরা ক্যান্সারের কাছে কিংবা দূরে যাই। আর এখানে কোনো সন্দেহই নেই যে উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে আসা খাবার স্তনের সুস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।”
এ ধরনের খাবার ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা কবচ তৈরি করে। অপরদিকে প্রাণিজ উৎসের খাবার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় ‘ইস্ট্রোজেন’ হরমোনের মাত্রা বাড়ানোর মাধ্যমে। আর এই হরমোনই ৮০ শতাংশ স্তন ক্যান্সার কোষের জ্বালানি যোগায়।
উদ্ভিজ্জ উৎসের খাবার এই প্রভাবকে প্রশমিত করতে পারবে।
বিশেষ তিনটি খাবার: স্তন ক্যান্সার থেকে সুরক্ষিত থাকতে খাদ্যাভ্যাসে প্রতিদিন থাকা চাই ব্রকলি, সয়া এবং তিশির গুঁড়া।
ডা. ফাঙ্ক বলেন, “আধা কাপ কাঁচা কিংবা ভাপে সিদ্ধ ব্রকলি খাওয়ার মাধ্যমে শরীরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াইকারী ‘আইসোথাইয়োসায়ানেইটস’ নামক উপাদানের মাত্রা বাড়ানো যায়। খাওয়ার সময় ব্রকলি ভালোভাবে চিবাতে হবে। এতে ব্রকলির বিভিন্ন ‘মলিকিউল’ মিশে তৈরি হবে ‘সালফোরাফেন।”
ডা. ফাঙ্কের ভাষায়, এই উপাদান স্তন ক্যান্সারের জন্য দায়ী কোষগুলো খুঁজে বের করে ধ্বংস করতে অনন্য।
এরপর প্রতিদিন দুই থেকে তিন বেলা সয়া খেতে হবে। সয়া স্তন ক্যান্সার হওয়া, একবার সেরে যাওয়া পর আবার ফিরে আসা এবং তা থেকে মৃত্যু সবকিছুই দমাতে অত্যন্ত সহায়ক।
আর খেতে হবে এক টেবিল-চামচ তিশির গুঁড়া। যা একটি শক্তিশালী ক্যান্সার রোধকারী ‘ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট’ সরবরাহ করে, যার নাম ‘লিগনান্স’।
অ্যালকোহল বাদ: ডা. ফাঙ্ক বলেন, “অ্যালকোহলের কোনো নিরাপদ পরিমাণ নেই। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে, ‘ইস্ট্রোজেন’য়ের মাত্রা বাড়ায়। পাশাপাশি শরীরের ‘ফোলেইট’ উপাদানটিকে ‘মিথাইলফোলেইট’য়ে পরিণত করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে অ্যালকোহল।”
‘মিথাইলফোলেইট’য়ের কাজ হল জিনগত বৈশিষ্ট্য রক্ষা করা। এসবই স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ‘মিথাইলফোলেইট’য়ের ‘সাপ্লিমেন্ট’ নেওয়া যায়।
শারীরিক পরিশ্রম: যারা নিয়মিত শরীরচর্চা করেন তাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি ২০ শতাংশ কম বলে দাবি করেন ডা. রিচার্ডসন।
অপরদিকে অলস জীবনযাত্রা এই রোগের ঝুঁকি বাড়ায় ৪০ শতাংশ, যোগ করেন ডা. ফাঙ্ক।
তার মানে এই নয় যে প্রচুর ব্যায়াম করতে হবে।
ডা. ফাঙ্ক বলেন, “দৈনিক মাত্র ১১ মিনিট ব্যায়াম করলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে ১৮ শতাংশ। শুধু হাঁটাহাঁটিই হতে পারে এই ব্যায়াম।”
স্বাস্থ্যকর ওজন: অতিরিক্ত ওজন নানান স্বাস্থ্য সমস্যা ডেকে আনে, এমনকি স্তন ক্যান্সারও।
ডা. ফাঙ্ক বলছেন, “অতিরিক্ত ওজন, ‘ওবেসিটি’ রজঃবন্ধ হয়ে যাওয়া নারীদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় ৫০ থেকে ২৫০ শতাংশ। এদের মধ্য থেকে ৫০ শতাংশের মৃত্যুর জন্যও দায়ী হবে অতিরিক্ত ওজন।”
বিপদের ইঙ্গিত: স্তনে নতুন কিছু চোখে পড়লেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে দ্রুত।
ডা. ফাঙ্ক বলেন, “বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্তনে নতুনভাবে দেখা দেওয়া যে কোনো বিষয়ই হবে সাধারণ, ভয়ের কোনো কারণ থাকবে না। তাই বলে চিকিৎসককে বার বার দেখালে কেউ বিরক্ত হবে না।”
ঝুঁকিপূর্ণ ইঙ্গিত হতে পারে নতুন কোনো ‘লাম্প’ বা গোটা, ফুলে যাওয়া, স্তন কিংবা বৃন্তে ব্যথা, বৃন্ত ছোট হওয়া ইত্যাদি।