রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে অনেকের ঘুমের মধ্যে তীব্র নাক ডাকার শব্দ পাশের মানুষটির ঘুম কেড়ে নেয়। এই সমস্যাটি কেবল বিরক্তিকরই নয়, এটি একটি গুরুতর স্বাস্থ্যগত অবস্থা, যার নাম অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া (OSA)। অ্যাপনিয়া বলতে বোঝায় যখন শ্বাস-প্রশ্বাস ১০ সেকেন্ডের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকে। OSA আক্রান্তদের ক্ষেত্রে এই সময়টা ১০ থেকে ৩০ সেকেন্ড বা তারও বেশি হতে পারে, যার ফলে শ্বাস নিতে গিয়ে বারবার ঘুম ভেঙে যায়। দিনের কর্মব্যস্ততার পর যখন শরীর শিথিল হয়, তখন শ্বাসতন্ত্রের মাংসপেশিগুলোও রিলাক্স হয়ে যায়, যার কারণে বাতাস চলাচল ব্যাহত হয় এবং নাক ডাকার সৃষ্টি হয়।
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া কী এবং কাদের হয়?
স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রতি রাতে ১০০ বার বা তারও বেশিবার জেগে ওঠেন। এর ফলে সারা দিন তারা ক্লান্তি অনুভব করেন, মনোযোগ দিতে পারেন না এবং দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এই অবস্থায় রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ ৪০ শতাংশ বা তারও বেশি কমে যেতে পারে, যা মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্রমে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এই রোগে আক্রান্তরা প্রায়শই ঘুমের মধ্যে দাঁত কাটেন এবং ঘন ঘন শ্বাস নেন।
৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ঘুমের মধ্যে নাক ডাকা স্বাভাবিক হলেও, ৫-১৫ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা থাকলে একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। মধ্যবয়স্ক থেকে বৃদ্ধ বয়সীদের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
কারা এই রোগের ঝুঁকিতে আছেন?
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার ৮০-৯০% ক্ষেত্রে সঠিক কারণ নির্ণয় করা কঠিন হলেও, কিছু নির্দিষ্ট কারণ ঝুঁকির প্রবণতা বাড়ায়:
স্থূলতা: যারা অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতায় ভুগছেন।
পুরুষদের গ্রিবার দৈর্ঘ্য: যাদের গ্রিবার দৈর্ঘ্য ১৭ ইঞ্চি বা তার বেশি (মহিলাদের ক্ষেত্রে ১৬ ইঞ্চি বা তার বেশি)।
বয়স: ৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব পুরুষ এবং ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া মহিলা।
শারীরিক গঠন: যাদের গলার হাড় এবং মাংসপেশির জন্মগত ত্রুটি আছে।
অন্যান্য রোগ: ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত রোগী, যেসব শিশুর টনসিল এবং এডিনয়েড গ্রন্থি বড়, হরমোনজনিত রোগ যেমন অ্যাক্রোমেগালি এবং হাইপোথাইরয়েডের রোগী।
জীবনযাপন: যারা মদ্যপ, ধূমপান এবং ঘুমের বড়ি সেবনে অভ্যস্ত, যারা রাতের বেলা হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত, এবং যারা রাত জেগে থাকেন ও সময়মতো ঘুমান না।
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার ভয়াবহ পরিণতি
সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না হলে দেহের অক্সিজেনের মাত্রায় তারতম্য ঘটে। এর ফলে বুক ধড়ফড় করা, হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, দিনের বেলা রক্তচাপ বৃদ্ধি এবং রাতের বেলা কমে যাওয়া, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বৃদ্ধি, হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি, এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তিরা কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না, বিষণ্নতায় ভোগেন, এবং তাদের যান্ত্রিক যান চালানো মোটেই নিরাপদ নয়। এর ফলে বেড পার্টনারের ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটে। বিদেশে বিবাহবিচ্ছেদের অন্যতম কারণ হিসেবেও নাক ডাকা বিবেচিত হয়।
চিকিৎসা পদ্ধতি ও পরামর্শ
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার চিকিৎসা শুরু করার আগে সঠিক রোগ নির্ণয় অত্যন্ত জরুরি। যারা এই সমস্যায় ভুগছেন তাদের সারা রাত ধরে ল্যাবরেটরি বা স্লিপ সেন্টারে গিয়ে পলিসমনোগ্রাফি পরীক্ষা করাতে হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে ব্রেইন, হার্ট এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের কার্যক্ষমতা বিস্তারিতভাবে জানা যায়। আমাদের দেশে কিছু বিশেষ কেন্দ্রে এই পরীক্ষা করা হয়ে থাকে।
সিপিএপি (CPAP): এটি অন্যতম কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি। নাকের মাধ্যমে কন্টিনিউয়াস পজেটিভ এয়ারওয়ে প্রেসার মাস্ক ব্যবহার করে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিশ্চিত করা হয় এবং শ্বাসনালী খোলা থাকে। এটি মধ্যম এবং তীব্র মাত্রার অ্যাপনিয়ায় আক্রান্তদের জন্য সঠিক চিকিৎসা। একজন স্লিপ বিশেষজ্ঞ বা বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ এটি নির্বাচন করে দিতে পারেন।
বিকল্প চিকিৎসা: কিছু ক্ষেত্রে মুখের মধ্যে এক ধরনের গার্ড ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও, মুখ গহ্বরের নরম তালু, ইউভুলা, টনসিল, এডিনয়েড বা জিহ্বার অপারেশন ক্ষেত্রবিশেষে নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞরা করে থাকেন। এটি একটি ব্যয়বহুল এবং জটিল অপারেশন, যা নির্দিষ্ট কিছু কেন্দ্রে করা হয়।
জীবনযাপনের পরিবর্তন এনেও মিলতে পারে সুফল
যারা মৃদু প্রকৃতির অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ায় ভুগছেন তাদের জন্য কিছু পরামর্শ:
ওজন কমানো: অতিরিক্ত ওজন থাকলে একজন পুষ্টিবিদের মাধ্যমে আদর্শ ওজনে আসার চেষ্টা করুন।
ঘুমের ভঙ্গি: চিৎ হয়ে ঘুমানো পরিহার করুন। ডান বা বাঁ দিকে পাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
বিছানা: বিছানার মাথার দিকটা সামান্য উঁচু করে রাখলে সুফল পাওয়া যায়। বাজারে কার্ডিয়াক বেড পাওয়া যায়, যা ব্যবহার করলেও উপকার মিলবে।
নাকের ড্রপ: বাজারে অনেক ধরনের নাকের ড্রপ বা তৈলাক্ত পদার্থ পাওয়া যায় যা রাতের বেলা ঘুমানোর আগে ব্যবহার করলে নাক ডাকা কিছুটা কমতে পারে। তবে এগুলি অ্যাপনিয়ার চিকিৎসায় কোনো ভূমিকা রাখে না।
আপনার দিনের বেলা অতিরিক্ত ঘুম আসে কি? (এস.এস. স্কোর)
নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে আপনার অতিরিক্ত দিবা নিদ্রা আছে কিনা তা যাচাই করতে পারেন:
প্রশ্ন স্কোর
বসে বই পড়ার সময়
টিভি দেখার সময়
সিনেমা/সভায় বসে থাকলে
গাড়িতে এক ঘণ্টার বিরতিহীন ভ্রমণ
অপরাহ্নে শুয়ে বিশ্রাম নেয়ার সময়
বসে কারও সঙ্গে কথা বলার সময়
দুপুরে আহারের পরে বসে থাকলে
ট্রাফিক সিগন্যালে কয়েক মিনিট গাড়ি থেমে থাকলে