দেশের বৃহত্তম আইটি সংস্থা টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (TCS)-এ কর্মীদের ব্যাপক ছাঁটাই নিয়ে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। এবার এই ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে টাটা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ‘লাল চোখ’ দেখিয়ে দেশজুড়ে টিসিএস কার্যালয় ঘেরাওয়ের ডাক দিয়েছে সিপিআইএম-এর শ্রমিক শাখা সিটু (CITU)। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, মোটা বেতন পাওয়া আইটি কর্মীরাও নিজেদের জীবিকা বাঁচাতে এই আন্দোলনে সামিল হচ্ছেন।
সিটু’র প্রতিবাদ ও ঘেরাও কর্মসূচি:
দ্য হিন্দু পত্রিকার খবর অনুযায়ী, টিসিএস-এর ইনফোপার্ক ক্যাম্পাসে কর্মীদের ‘পিঙ্ক স্লিপ’ (চাকরি থেকে ছাঁটাই) দেওয়ার প্রতিবাদে সেন্টার অফ ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস (CITU) মাঠে নেমেছে। শ্রমিক সংগঠন সিটু জানিয়েছে যে, এই ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে দেশজুড়ে টিসিএস কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি চলবে। বাম শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন, এই প্রতিবাদ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য হলো আইটি ক্ষেত্রে চাকরি ও কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবি জানানো। তারা উল্লেখ করেছেন যে, ‘আগের মতো নয়, এবার কর্মীরা নিজেদের কথা বলতে শুরু করেছেন এবং প্রতিবাদে অংশ নিতে রাজি হয়েছেন।’
পশ্চিমবঙ্গেও টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস থেকে কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে সিটু সূত্রে জানা গেছে, ৪ঠা অগাস্ট সোমবার, উত্তর ২৪ পরগনার টিসিএস লর্ডস-এর সামনে ঘেরাও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সিটু আরও জানিয়েছে, টিসিএস সহ অন্যান্য আইটি কোম্পানিগুলো পশ্চিমবঙ্গে তথা সারা দেশে যে ‘অনৈতিক কর্মী ছাঁটাই’ শুরু করেছে, তার প্রতিবাদেই এই পদক্ষেপ। উল্লেখ্য, আইটি কর্মীদের অনৈতিকভাবে ছাঁটাই করার প্রতিবাদে সিপিআইএম-এর শ্রমিক শাখা সামিল হলেও, এ রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন এই বিষয়ে নীরব রয়েছে।
শ্রম মন্ত্রকের তলব ও টিসিএস-এর ব্যাখ্যা:
আর্থিক বিষয়ক সংবাদপত্র মানি কন্ট্রোল জানিয়েছে, ব্যাপক ছাঁটাই এবং নতুন কর্মীদের নিয়োগে বিলম্বের বিষয়ে আলোচনা করার জন্য শ্রম মন্ত্রকের আওতাধীন চিফ লেবার কমিশনার (CLC) আজ, শুক্রবার ১ অগাস্ট তারিখে টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (TCS)-এর সিনিয়র নির্বাহীদের তলব করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিসিএস ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে তার কর্মীসংখ্যা ২ শতাংশ কমাতে পারে, যার ফলে প্রায় ১২,০০০ কর্মীর চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। এই বিষয়ে সংস্থার সিইও কে. কীর্তিবাসন বলেছেন, “এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) থেকে ২০ শতাংশ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কারণে নয়। আমরা এটি করছি না। এটি হচ্ছে সেইসব ক্ষেত্রে যেখানে দক্ষতার অমিল রয়েছে বা যাদের উপযুক্তভাবে কাজে লাগানো যায়নি।”
NITES-এর অভিযোগ:
নেসেন্ট ইনফরমেশন টেকনোলজি এমপ্লয়িজ সিনেট (NITES) সম্প্রতি CLC-এর দপ্তরে দুটি চিঠি পাঠিয়ে শ্রম মন্ত্রকের হস্তক্ষেপ দাবি করেছে। চিঠিতে NITES, টিসিএস-এর ছাঁটাইকে “অমানবিক”, “অনৈতিক” এবং “সম্পূর্ণ বেআইনি” বলে অভিহিত করেছে। তারা সকল ছাঁটাই অবিলম্বে বন্ধ করার এবং প্রভাবিত কর্মীদের পুনরায় নিয়োগের দাবি জানিয়েছে। NITES সভাপতি হরপ্রীত সিং সালুজা লিখেছেন, “যাদের ছাঁটাই করা হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই ১০ থেকে ২০ বছর ধরে সংস্থায় কাজ করে আসা মধ্য ও উচ্চ পর্যায়ের পেশাদার। রবিবার সন্ধ্যায় হঠাৎ করে কোনো পূর্ব ঘোষণা বা আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ছাড়াই একটি ইমেইল পাঠিয়ে ছাঁটাইয়ের কথা জানানো হয়েছে। এটি কেবল অনৈতিক এবং অমানবিক নয়, বরং সম্পূর্ণ বেআইনি। টিসিএস সরকারকে কোনো আগাম নোটিশ না দিয়েই হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই করার পরিকল্পনা করেছে, যা বর্তমান ভারতীয় শ্রম আইনের পরিপন্থী।”
তিনি আরও বলেন, “ভারতের আইটি খাতে লাখ লাখ পেশাদার কাজ করেন এবং এটি আমাদের অর্থনীতির একটি স্তম্ভ। যদি টিসিএস-এর মতো একটি সংস্থাকে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে নির্বিচারে ছাঁটাই করার অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে তা অন্যান্য কোম্পানির জন্য এক বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। এটি চাকরির অনিরাপত্তাকে স্বাভাবিক করে তুলবে, কর্মচারীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করবে এবং ভারতের চাকরি ব্যবস্থার উপর আস্থা নষ্ট করবে।”
বিশেষজ্ঞদের মত:
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক আইটি খাতে হোয়াইট-কলার কর্মীদের ছাঁটাইয়ের ঘটনাগুলিকে মূলত বাণিজ্যিক ও চুক্তিভিত্তিক প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত, যেখানে শ্রম মন্ত্রকের সরাসরি ভূমিকা সীমিত। এমারাল্ড ল’ অফিসেস-এর পার্টনার আস্থা সিং ত্রেহান বলেন, “মন্ত্রক যদি কোনো তলব জারি করে, তাহলে তা সম্ভবত খতিয়ে দেখার জন্য যে সেখানে কোনো বেআইনি বা বৈষম্যমূলক আচরণ হয়েছে কিনা যেমন বয়স, লিঙ্গ বা হুইসেলব্লোয়ার হওয়ার কারণে কাউকে লক্ষ্যবস্তু করা অথবা কর্মী ও সংস্থার মধ্যে সমঝোতার পথ খুঁজতে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে হতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “মূলত কর্মীসংখ্যা ও ছাঁটাই সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো বেসরকারি নিয়োগকারীদের নিজস্ব এখতিয়ারে পড়ে, যা নিয়ন্ত্রিত হয় চাকরির চুক্তি, অভ্যন্তরীণ এইচআর নীতি এবং সামগ্রিক ব্যবসায়িক প্রয়োজনে।”
এই ঘটনা ভারতের বিশাল আইটি শিল্পে চাকরির সুরক্ষা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে এবং আগামী দিনে এই বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তা দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট মহল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।