মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি উপেক্ষা? জমি দখলের অভিযোগ তৃণমূল কাউন্সিলর ও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কঠোর হুঁশিয়ারির পরও মালদহের ইংরেজবাজার পুরসভায় সরকারি জমি দখলের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের তীর স্বয়ং শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের কাউন্সিলর মনীষা সাহা মণ্ডল এবং পুরসভার চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীর দিকে। যদিও দুজনেই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

অভিযোগের নেপথ্যে কী?
ইংরেজবাজার পুরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মালঞ্চপল্লি এলাকায় একটি সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে, যা প্রায় চার একর জমির উপর বিস্তৃত। অভিযোগ, এই মূল্যবান সরকারি জমির একাংশ দখলের চেষ্টা করছেন এলাকার কাউন্সিলর মনীষা সাহা মণ্ডলের স্বামী। তিনি নাকি শাসকদলের প্রভাব খাটিয়ে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের এই জমির একটি অংশ ইটের প্রাচীর ও লোহার জাল দিয়ে ঘিরে ফেলছেন।

সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অফিস ইনচার্জ কার্তিকচন্দ্র সরকার এই বিষয়ে বলেন, “এটা একসময় পুলিশ বিভাগের জায়গা ছিল। ১৯৬৪ সালে একটি সরকারি নির্দেশিকায় জায়গাটি আমাদের দফতরকে দেওয়া হয়। এই জমিতে শুধু অফিস কিংবা কলেজ নয়, হোস্টেলও তৈরি হয়েছে। স্থানীয় লোকজনই সরকারি এই জায়গা দখল করার চেষ্টা করছে। তৃণমূলের কাউন্সিলর নিজেই এখানে জমি ঘেরার কাজ করাচ্ছেন। তিনি বলছেন, খেলার জন্য তাঁরা জায়গা ঘিরছেন।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আমাদের না জানিয়েই এসব কাজ করা হয়েছে। আমি জানিয়ে দিয়েছি, খেলার জন্য এভাবে সরকারি জায়গা ঘেরা যায় না। তাঁকে আমি ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছি। এখন দেখা যাক, তিনি কী ব্যবস্থা নেন। প্রয়োজন হলে আমাকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাতে হবে।” কার্তিকচন্দ্র সরকার আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “এই জায়গা যে কোনো মুহূর্তে কলেজের প্রয়োজন হতে পারে। যা মনে হচ্ছে, কাউন্সিলর তাঁর প্রভাব খাটিয়ে সরকারি এই জায়গা ঘেরার কাজ শুরু করেছেন। এখানে আমাদের দফতরের ৩.৯৬ একর জায়গা রয়েছে। তার মধ্যে কত অংশ ঘেরা হচ্ছে, তা অবশ্য মাপজোক না-করে বলতে পারব না।”

তৃণমূল কাউন্সিলর ও চেয়ারম্যানের সাফাই
এই অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তৃণমূলের কাউন্সিলর মনীষা সাহা মণ্ডল অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদমাধ্যমকে বেশ কিছু পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, “সরকারি জমি দখলের অভিযোগ কে করেছে? কোনো দল নাকি এলাকাবাসী? ওই জমি দখলের কোনো পরিস্থিতি কি দেখা গিয়েছে? আমি নিশ্চিত, এলাকার কেউ এই জায়গা নিয়ে একটাও কথা বলবে না। কারণ, ওই জায়গা নিয়ে প্রচুর মানুষ ভুক্তভোগী।”

তিনি আরও জানান, “ওই জায়গায় একটি খেলার পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। ওখানে কোনো ঘর, ক্লাব বা মন্দির তৈরি করা হচ্ছে না। ওই মাঠে যাতে বাচ্চারা খেলতে পারে তার জন্য মাটি ফেলে মাঠটি সমান করা হয়েছে। এর বাইরে কিছু হয়নি। কেউ ব্যক্তিগত স্বার্থে যদি অভিযোগ করে থাকে তবে আপনারা সরেজমিনে মাঠটি দেখুন।” মণীষাদেবী দাবি করেন, “ওই মাঠের পাশে এসএসসি দফতরের ভবন রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে মাঠটিতে মাদকাসক্তদের আনাগোনা হচ্ছিল। বহুবার চেষ্টা করেও আমরা সেই সমস্যার সুরাহা করতে পারিনি। এটা বন্ধ করতেই সেখানে খেলার পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। বাচ্চারা যাতে দিনে ও রাতে খেলতে পারে তার জন্য কিছু আলোও লাগানো হয়েছে।”

তবে, কার টাকায় মাঠের চারপাশে প্রাচীর বা লোহার জাল লাগানো হচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি মণীষাদেবী। সরকারি মাঠে খেলার পরিবেশ তৈরি করার জন্য পুরকর্তৃপক্ষ তাকে কোনো অনুমতি দিয়েছে কি না, বা বোর্ড অফ কাউন্সিলর্স সভায় এই বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নেও তিনি নিরুত্তর ছিলেন। যদি পুরসভা এই কাজের অনুমতি দিয়ে থাকে, তবে কোন ফান্ড থেকে অর্থ খরচ হচ্ছে, এক লাখ টাকার বেশি কাজের জন্য কোনো টেন্ডার করা হয়েছে কি না, বা কোন ঠিকাদার সংস্থা এই কাজের বরাত পেয়েছে—এসব প্রশ্নেরও কোনো উত্তর মেলেনি।

ইংরেজবাজার পুরসভার চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী বলেন, “আমি যতদূর জানি, ওই জায়গাটিতে নোংরা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সাপের আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এলাকার মানুষজন বাড়ির আবর্জনা সেখানে ফেলতেন। ওখানকার ছোট ছোট ছেলেরা জায়গাটি পরিষ্কার করে খেলার উপযোগী করে তুলেছে। এক্ষেত্রে জায়গা ঘেরা বা দখলের কোনো বিষয় নেই। ওই জায়গায় কীর্তনের আসর বসে, আবার বিয়ের অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়।”

মুখ্যমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশিকা
সম্প্রতি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার কোথাও সরকারি জমি দখল না করার জন্য কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। জানুয়ারি মাসে নবান্নে আয়োজিত প্রশাসন বৈঠকে তিনি জানিয়েছিলেন, কোথাও সরকারি জমি জবরদখলের ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপার এবং থানার আইসির বিরুদ্ধে ‘স্ট্রং অ্যাকশন’ নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে জেলাশাসকদেরও ঘরে বসে না থেকে সরকারি জমি জবরদখল রুখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।

স্থানীয়দের আশঙ্কা
স্থানীয়দের একাংশ আশঙ্কা করছেন, সরকারি জমি বা বিল ভরাটের সূত্রপাত এভাবেই হয়। প্রথমে সেই জায়গা টিন বা অন্য কিছু দিয়ে ঘেরা হয়, ভিতরে জমি সমান করার কাজ চলতে থাকে। জলা হলে ট্র্যাক্টর ভর্তি আবর্জনা ফেলা শুরু হয়। জমি একবার সমান হয়ে গেলে হঠাৎ একদিন রাতারাতি সেখানে গজিয়ে ওঠে কোনো মন্দির বা ক্লাব। তারপরেই সেই জায়গা প্লট করে বিক্রি করা শুরু হয়। এক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে কি না, তা সময়ই বলবে। এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy