হিজিবিজি আঁকা মানসিক স্বাস্থ্যের নির্ণয় করে : গবেষণা

হাতের কাছে কাগজ-কলম বা পেনসিল থাকলে কমবেশি সবাই মনের অজান্তে কখনো সখনো হিজিবিজি আঁকেন। যদিও সেসব আঁকিবুকির তেমন কোনো অর্থ হয় না।

তবে জানলে অবাক হবেন, আপনার মনের অজান্তে আঁকা বিভিন্ন হিজিবিজি শব্দ কিংবা ছবিরও গুরুত্বপূর্ণ অর্থ থাকতে পারে। এ কারণে অনেক সময় দেখা যায় মনোবিদরা এসব হিজিবিজি আঁকিবুকির গুরুত্ব খোঁজের কোনো ব্যক্তির মানসিক অবস্থা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে।

হিজিবিজি লেখা বা আঁকাকে বলা হয় ডুডল। এই বিষয় সম্পর্কে কমবেশি সবাই ধারণা পান গুগল থেকে। কারণ প্রায়েই বিভিন্ন দিবস কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্মরণে গুগলে ডুডল প্রকাশ করা হয়। ঠিক তেমনই প্রতিবছর ৩ সেপ্টেম্বর পালিত হয় ন্যাশনাল ডুডল ডে।

জাতীয় ডুডল দিবসের ইতিহাস

মানুষ অনেক দিন ধরেই যোগাযোগের জন্য ডুডল ব্যবহার করে আসছে। এর প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় প্রাগৈতিহাসিক গুহার অঙ্কনে। সেই অঙ্কন ও প্রতীকগুলো, সম্ভবত লাঠি ও পাথর (এমনকি হাত) দিয়েও তৈরি করা হয়েছে।

প্রাচীনকালের নমুনা নিয়ে অধ্যয়নরত বিজ্ঞানীরা প্রাচীন ডুডল নিয়ে নানা তথ্য উপাত্ত পেয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, মেসোপটেমিয়ার সমাজ থেকে মাটির ট্যাবলেটের পাশ ও প্রান্তে এলোমেলো চিত্রের প্রমাণ পেয়েছেন। কিছু ইতিহাসবিদ বিশ্বাস করেন, একটি শিল্প ফর্ম হিসেবে ডুডলিং সব সময়ই গ্রহণযোগ্য ঝিল।

আমেরিকায় প্রাক-বিপ্লবী যুদ্ধের সময়, ব্রিটিশ সামরিক অফিসারদের একটি দল ‘ইয়াঙ্কি ডুডল’ নামে একটি গান তৈরি করেছিল। যেটি তারা অসংগঠিত আমেরিকান সৈন্যদের উপহাস করার জন্য গেয়েছিল। তখন ‘ডুডল’ শব্দের অর্থ বিবেচিত হয় বোকা বা সিম্পলটন হিসেবে।

মার্কিনরা গানটিকে তাদের নিজস্ব হিসাবে গ্রহণ করেছিল। যুদ্ধের সময় তাদের শত্রুদের উপহাসের জন্য এটি পরিবর্তন করেছিল। ধীরে ধীরে শব্দটি বিবর্তিত হয়েছে, এখন এর অর্থ দাঁড়িয়েছে ‘কিছু না করা’।

২০ শতকে, ‘মি. ডিডস গোস টু টাউন’ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে অনুপস্থিত-মন সম্পর্কে কথা বলার জন্য ডুডল শব্দটি ব্যবহার করেছিল।

একই সময়ে ব্যক্তিত্বের ব্যাখ্যা করার জন্য অবচেতন মনের অধ্যয়ন জনপ্রিয়তা অর্জন করে। জানা যায়, মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা কাটানোর জন্য ডুডলিং বেশ কার্যকরী।

হিজিবিজি আঁকা বা ডুডলিংয়ের যত উপকারিতা

>> ডুডলিং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। মস্তিষ্ককে ব্যস্ত রাখতে ও মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকরী এক অনুশীলন হতে পারে ডুডলিং।

>> অবিশ্বাস্য হলেও সত্যিই যে, ডুডলিংয়ের মাধ্যমে স্মৃতিশক্তি আরও উন্নত করা যায়। ডুডলিং নিয়ে সবচেয়ে বড় অধ্যয়নগুলোর মধ্যে একটি ছিল যুক্তরাজ্যের প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যাকি অ্যান্ড্রেডের গবেষণা। তিনি প্রমাণ করেন যে ডুডলিং স্মৃতিশক্তি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

>> সৃজনশীলতা বাড়াতেও সাহায্য করে ডুডলিং। যখন মানুষের কোনো কাজ থাকে না তখন তাদের মস্তিষ্ক ডিফল্ট মোডে চলে যায়, তবে ডুডলিংয়ের মাধ্যমে মস্তিষ্ককে ঘুমিয়ে পড়া থেকে বিরত রাখা যায়। ফলে সৃজনশীলতা আরও বাড়ে।

১৯৬৩ সালে একটি কনফারেন্সে বসে পোলিশ গণিতবিদ স্ট্যানিস্লো উলম তার কাগজে সংখ্যার একটি বর্গাকার সর্পিল আঁকতে শুরু করেন। তারপর তিনি নিজের অজান্তেই সব মৌলিক সংখ্যাকে প্রদক্ষিণ করেন ও একটি প্যাটার্ন লক্ষ্য করেন।

মৌলিক সংখ্যাগুলো সর্পিলের কর্ণ বরাবর সাজানো ছিল। উলাম অসাবধানতাবশত ডুডলিংয়ের মাধ্যমে মৌলিক সংখ্যার জন্য একটি লুকানো গাণিতিক প্যাটার্ন আবিষ্কার করেছিলেন।

একই ভাবে আলেকজান্ডার পুশকিন তার পান্ডুলিপির প্রান্ত বরাবর তার কবিতা থেকে মুখ ও মানুষের ডুডল করতেন, সম্ভবত সেগুলোকে তিনি কল্পনায় জীবিত করতেন।

>> আপনি যখন হতাশাগ্রস্ত বা উদ্বিগ্ন হন, তখন সেই অনুভূতিগুলোকে শব্দে প্রকাশ করা কঠিন হতে পারে। তবে ওই মুহূর্তে এমন একটি চিত্র মনে আসতে পারে যা আপনার অনুভূতি বর্ণনা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি ডুডল হাজার শব্দের আক্ষরিক উদাহরণ।

>> মানসিক চাপ কমাতেও আপনি করতে পারে ডুডলিং। গবেষণায় দেখা গেছে, সৃজনশীলতার পাশাপাশি রং করা বা কোলাজ আঁকাসহ বিভিন্ন ডুডলিং আপনার মনকে শান্ত করতে সহায়তা করে।

‘চিলিং আউট: দ্য সাইকোলজি অব রিলাক্সেশন’ বইতে মনোবিজ্ঞানী ক্রিস্টিন সেলবি স্ট্রেস রিলিফের জন্য একটি নির্দিষ্ট ডুডলিং কৌশলের সুপারিশ করেছেন।

তিনি পৃষ্ঠা জুড়ে একটি ক্রমাগত রেখা একেঁ সমান ঘর তৈরি করার পরামর্শ দেন। তারপর লাইনের ফাঁকা স্থান পূরণ করতে ভিন্ন ভিন্ন রং ব্যবহার করতে পারেন।

>> ডুডলিংয়ের মাধ্যমে শেখার মনোভাবও বাড়ে। বিভিন্ন অধ্যয়নে দেখা যায়, বক্তৃতা ও অ্যাসাইনমেন্টের সময় যে শিক্ষার্থীরা আঁকেন তারা আরও তথ্য ধরে রাখেন ও জটিল ধারণাগুলো ভালোভাবে মনে রাখতে পারেন।

>> ডুডলিং মেজাজ উন্নত করতেও সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, আপনাকে আরও সুখী করতে পারে! ২০০৮ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, যেখানে অংশগ্রহণকারীদের এমন কিছু আঁকতে বলা হয়েছিল যা তাদের অসন্তুষ্ট করে অথবা এমন কিছু যা তাদের খুশি করে। এরপর যারা নিজেদের খুশিমতো ডুডল এঁকেছেন তাদের মেজাজের উন্নতি ঘটেছে।

Related Posts

© 2024 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy